2 ডিসেম্বর 2025

শিক্ষা খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: ইউরোপের চিত্র এবং উচ্চশিক্ষায় রূপান্তর

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) এখন আর কল্পবিজ্ঞানের বিষয় নয়, বরং এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। চ্যাটজিপিটির মতো আধুনিক সব টুল ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা যেমন তাদের বাড়ির কাজ বা প্রবন্ধ লিখছে, তেমনি শিক্ষকরাও পাঠদানের প্রস্তুতি নিতে প্রযুক্তির সহায়তা নিচ্ছেন। তবে প্রশ্ন হলো, ইউরোপের শিক্ষকরা ক্লাসরুমে কতটা এআই ব্যবহার করছেন এবং কোন দেশগুলো এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে?

ইউরোপের শ্রেণিকক্ষে এআই ব্যবহারের চালচিত্র

২০২৪ সালের অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)-এর ‘টিচিং অ্যান্ড লার্নিং ইন্টারন্যাশনাল সার্ভে’ (TALIS) অনুযায়ী, ইউরোপজুড়ে শিক্ষকদের এআই ব্যবহারের হারে ব্যাপক তারতম্য লক্ষ্য করা গেছে। ৩২টি দেশের ওপর চালানো এই জরিপে দেখা গেছে, ফ্রান্সে মাত্র ১৪ শতাংশ নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষক এআই ব্যবহার করেন, যেখানে আলবেনিয়ায় এই হার ৫২ শতাংশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নে গড়ে ৩২ শতাংশ এবং ওইসিডি ভুক্ত দেশগুলোতে গড়ে ৩৬ শতাংশ শিক্ষক পাঠদান বা শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য গত এক বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করেছেন।

মজার বিষয় হলো, পশ্চিম ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর তুলনায় পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম বলকান অঞ্চলের দেশগুলোতে শিক্ষকদের মধ্যে এআই ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। আলবেনিয়া ছাড়াও মাল্টা, চেক প্রজাতন্ত্র, রোমানিয়া, পোল্যান্ড, কসোভো এবং নরওয়ের মতো দেশগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষক ক্লাসরুমে প্রযুক্তির সহায়তা নিচ্ছেন। অন্যদিকে ফিনল্যান্ড, ইতালি, তুরস্ক এবং ফ্রান্সের মতো দেশগুলো এ ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে রয়েছে।

কেন এই ব্যবধান?

দেশভেদে এই পার্থক্যের মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে সরকারি নীতিমালা এবং অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার ভিন্নতা। ইউনেস্কোর মতে, কিছু দেশ জাতীয় শিক্ষানীতিতে এআইকে দ্রুত অন্তর্ভুক্ত করেছে, আবার কিছু দেশ শিক্ষার্থীদের বয়স বিবেচনায় জেনারেটিভ এআই ব্যবহারে কঠোর বা সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। ওইসিডির সিনিয়র প্রজেক্ট ম্যানেজার রুচেন লি মনে করেন, ইন্টারনেট ফায়ারওয়াল, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং এআই ব্যবহারে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব এই ব্যবধানের বড় কারণ। যে সব দেশে শিক্ষকদের এআই বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, সেখানে এর ব্যবহারের হারও বেশি। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রান্সে এ বছরই সরকারি স্কুলগুলোতে দেশব্যাপী এআই প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে, যা হয়তো ভবিষ্যতের পরিসংখ্যানে পরিবর্তন আনবে।

উচ্চশিক্ষায় এআই: একটি অপরিহার্য হাতিয়ার

স্কুল পর্যায়ের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে চ্যালেঞ্জটা ভিন্ন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন বাজেট স্বল্পতা এবং কর্মী সংকটের মধ্যেও শিক্ষার্থীদের ধরে রাখার লড়াইতে অবতীর্ণ হয়েছে। আধুনিক শিক্ষার্থীরা অ্যামাজন, গুগল বা নেটফ্লিক্সের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অভ্যস্ত, তাই তারা নিজেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও একই রকম নিরবচ্ছিন্ন ও ব্যক্তিগত সেবা আশা করে। প্রথাগত অফিস আওয়ার বা কল সেন্টারের মাধ্যমে এখন আর হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

এখানেই ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এটি শুধুমাত্র সাধারণ প্রশ্নের উত্তর বা ২৪/৭ চ্যাটবট সুবিধাই দিচ্ছে না, বরং ওরিয়েন্টেশন থেকে শুরু করে গ্র্যাজুয়েশন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত গাইড হিসেবে কাজ করছে। আধুনিক এআই সিস্টেমগুলো এখন আর জেনেরিক উত্তর দেয় না; বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ডাটাবেস, কোর্স ক্যাটালগ এবং নিয়মাবলী বিশ্লেষণ করে সঠিক তথ্য প্রদান করে। এর ফলে প্রশাসনিক দপ্তরের ওপর চাপ কমেছে এবং শিক্ষার্থীরাও দ্রুত সঠিক সেবা পাচ্ছে।

ঝরে পড়া রোধে প্রেডিক্টিভ অ্যানালিটিক্স

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য শিক্ষার্থী ঝরে পড়া বা ড্রপ-আউট একটি বড় আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ঝুঁকি। অনেক সময় শিক্ষার্থীরা সমস্যার কথা মুখে বলে না, কিন্তু তাদের আচরণে তার প্রতিফলন ঘটে। এআই-চালিত ‘প্রেডিক্টিভ অ্যানালিটিক্স’ ব্যবহার করে এখন শিক্ষার্থীদের ক্লাসে অনুপস্থিতি, গ্রেড কমে যাওয়া বা অনলাইন পোর্টালে নিষ্ক্রিয়তার মতো বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে আগেভাগেই সতর্ক করা সম্ভব হচ্ছে।

পরিসংখ্যান বলছে, যেসব প্রতিষ্ঠান এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার কমাতে সক্ষম হয়েছে। এর মাধ্যমে অ্যাডভাইজাররা অনুমানের ওপর নির্ভর না করে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে ঝুঁকিতে থাকা শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং করতে পারছেন। দিনশেষে, আজকের শিক্ষার্থীরা এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা চায় যা তাদের ডিজিটাল জীবনযাত্রার সঙ্গে মানানসই হবে—যেখানে তারা বহুভাষিক সহায়তা পাবে এবং সময়মতো প্রয়োজনীয় রিমাইন্ডার বা ‘নাজ’ (nudge) পেয়ে নিজেদের শিক্ষাজীবন গুছিয়ে নিতে পারবে।