2 ডিসেম্বর 2025

বিশ্বজুড়ে ফলের বাজারের ব্যাপক প্রবৃদ্ধি ও দেশীয় কামরাঙার পুষ্টিগুণ: একটি সামগ্রিক পর্যালোচনা

বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসেও বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে পুষ্টিকর ও ভেষজ গুণসম্পন্ন খাবারের প্রতি মানুষের আগ্রহ এখন তুঙ্গে। এই পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে ফলের বাজারেও, যেখানে হিমায়িত বা ফ্রোজেন ফল থেকে শুরু করে দেশীয় টাটকা ফলের কদর বাড়ছে সমানতালে। আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণ এবং দেশের পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতামত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ফল এখন আর কেবল মৌসুমি বিলাসিতা নয়, বরং দৈনন্দিন সুস্থতার অপরিহার্য অংশ।

আন্তর্জাতিক বাজারে হিমায়িত ফলের জয়জয়কার

ডেটাএম ইন্টেলিজেন্সের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববাজারে হিমায়িত ফলের চাহিদা অবিশ্বাস্য গতিতে বাড়ছে। ২০২২ সালে যেখানে এই বাজারের আকার ছিল ৩,৯৫৭.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে তা ৬,৫৪৯.৪ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ থেকে ২০৩১ সাল পর্যন্ত এই প্রবৃদ্ধির হার বা সিএজিআর হবে ৬.৫ শতাংশ। অর্গানিক ও উদ্ভিদভিত্তিক বা প্ল্যান্ট-বেসড খাবারের প্রতি ঝোঁক এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তির উন্নতির ফলেই এই বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই বিশাল বাজারের প্রায় ৪৩ শতাংশ শেয়ার নিয়ে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নেতৃত্ব দিচ্ছে। মানুষ এখন রেডি-টু-ইট বা চটজলদি খাওয়া যায় এমন স্ন্যাকস এবং দীর্ঘস্থায়ী পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাবারের দিকে ঝুঁকছে, যা এই শিল্পের প্রসারে বড় ভূমিকা রাখছে।

পশ্চিমা বিশ্বে ফলের বিপণনে নতুনত্ব

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে ফলের বাজারজাতকরণে আসছে নিত্যনতুন কৌশল। যুক্তরাষ্ট্রের সানঅপ্টা (SunOpta) হোল ফুডসের মতো স্বাস্থ্যসচেতন চেইন শপগুলোর জন্য নন-জিএমও এবং অর্গানিক মিশ্র বেরি ও আমের নতুন প্যাকেটজাত পণ্য বাজারে এনেছে। অন্যদিকে, ড্রিসকলস (Driscoll’s) স্মুদি তৈরির উপযোগী বিশেষ প্রযুক্তিতে হিমায়িত (আইকিউএফ) স্ট্রবেরি ও ব্লুবেরি বাজারজাত করে ই-কমার্সে ২০ শতাংশ বিক্রি বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। বনডুয়েল নর্থ আমেরিকা শরীরচর্চায় আগ্রহীদের কথা মাথায় রেখে কম ক্যালোরিযুক্ত ক্রান্তীয় ফলের মিশ্রণ বা ট্রপিক্যাল ফ্রুট ব্লেন্ডস তৈরি করছে।

ইউরোপেও পিছিয়ে নেই এই উদ্ভাবন। ফ্রান্স ও জার্মানির বাজারে বনডুয়েল পরিবেশবান্ধব প্যাকেজিং নিশ্চিত করে অর্গানিক বেরি মিক্স সরবরাহ করছে। এছাড়া আর্লা ফুডস (Arla Foods) যুক্তরাজ্য ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোতে দুগ্ধজাত পণ্যের বিকল্প হিসেবে দুগ্ধমুক্ত ফলের পিউরি বা ক্কাথ নিয়ে এসেছে, যা স্থানীয় সুপারশপগুলোতে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ডেল মন্ট ইউরোপ কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে সংগৃহীত পিচ ও অ্যাপ্রিকট ফলের স্লাইস বেকিং শিল্পের জন্য সরবরাহ করছে।

দেশীয় ফলের পুষ্টিগুণ: কামরাঙার উদাহরণ

বিশ্ববাজারে যখন প্রযুক্তিনির্ভর ফলের দাপট, তখন আমাদের দেশে হাতের কাছেই পাওয়া যায় কামরাঙার মতো পুষ্টিগুণে ভরপুর প্রাকৃতিক ফল। বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ফারাহ মাসুদার মতে, কামরাঙা কেবল একটি মৌসুমি ফলই নয়, কোনো কোনো গাছে এটি সারাবছরই পাওয়া যায় এবং এর রয়েছে অসাধারণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।

পুষ্টিগুণের বিচারে প্রতি ১০০ গ্রাম কামরাঙায় প্রায় ৫০ কিলো ক্যালোরি শক্তি, ০.৫ গ্রাম প্রোটিন, ০.১ গ্রাম ফ্যাট এবং ৫.১ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট বিদ্যমান। খনিজ উপাদানের ক্ষেত্রেও এটি পিছিয়ে নেই। এতে ৬.১ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ১.২০ মিলিগ্রাম আয়রন, ১১ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম এবং ০.৪ গ্রাম অন্যান্য খনিজ উপাদান পাওয়া যায়। এই পুষ্টিমান শরীরকে সুস্থ রাখতে দারুণ কার্যকর।

রোগ নিরাময় ও শারীরিক সুস্থতায় কামরাঙা

কামরাঙা মানবদেহে অনেকটা প্রাকৃতিক ঔষধির মতো কাজ করে। আঁশযুক্ত ফল হওয়ায় এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে এবং হজমজনিত সমস্যা সমাধানে বেশ উপকারী। যারা উচ্চ রক্তচাপ বা কোলেস্টেরলের সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জন্যও এটি একটি আদর্শ খাবার। এটি শরীরের ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। ফলের পটাশিয়াম ও সোডিয়াম উচ্চ রক্তচাপ হ্রাসে সহায়তা করে।

ত্বকের যত্নেও কামরাঙার জুড়ি মেলা ভার। এর জীবাণুনাশক ক্ষমতা ব্রণ ও ফুসকুড়ির মতো ত্বকের জটিলতা দূর করে ত্বককে সজীব রাখে। ডায়াবেটিস রোগীদের নিয়মিত কামরাঙা খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এছাড়া প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকায় এটি স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধ করে এবং দাঁত, মাড়ি ও হাড়ের সুরক্ষায় কাজ করে। এতে থাকা এলাজিক অ্যাসিড খাদ্যনালি বা অন্ত্রের ক্যান্সার প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

ঐতিহ্যবাহী ব্যবহার ও সতর্কতা

গ্রামবাংলায় সর্দি-কাশির উপশমে কামরাঙা পুড়িয়ে ভর্তা করে খাওয়ার প্রচলন দীর্ঘদিনের। এটি জ্বর ও ঠাণ্ডাজনিত সমস্যায় প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে এবং মুখের রুচি ও হজমশক্তি বাড়ায়। কামরাঙা যেহেতু টক ও ঠাণ্ডা জাতীয় ফল, তাই এটি ঘাম, কফ ও বাতনাশক হিসেবেও পরিচিত। এর পাতা ও কচি ফলের রসে ট্যানিন থাকায় তা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।

তবে এত গুণাগুণ থাকার পরেও খাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম মানা জরুরি। পুষ্টিবিদ ফারাহ মাসুদা খালি পেটে কামরাঙা খাওয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। খালি পেটে এটি খেলে গ্যাসের সমস্যা, পেটে ব্যথা কিংবা বমির মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তাই ভরা পেটে বা দুপুরের খাবারের পর এই ফল খাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত।